জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সই নেওয়ার জন্য পাঠানোর সময়সীমা আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছেন। এর আগে ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে খসড়া পাঠানোর কথা ছিল। সাড়ে ছয় মাসের দীর্ঘ সংলাপের পর তৈরি হওয়া এই সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সব দল সই করবে কি না, অধ্যাদেশ জারি করে কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব এবং নির্বাচনের আগে-পরে কী হবে—এসব প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েছে।
সনদের অঙ্গীকার এবং বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই সনদের যেসব প্রস্তাব অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ কোনো কালক্ষেপণ ছাড়াই বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু সংস্কারের ১৯টি মৌলিক বিষয়ের মধ্যে ১০টিতে বিভিন্ন দলের আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) রয়েছে। বাকি নয়টিতে শতভাগ ঐকমত্য।
কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ সপ্তাহেই বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনায় বসবে কমিশন। এরপর চূড়ান্ত সনদ ও বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ বৃহস্পতিবারের মধ্যে একসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে।”
সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের ওপর থাকবে বলে জানিয়েছে কমিশন। তারা রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সরকারের কাছে উপস্থাপন করবে।
অধ্যাদেশ জারি: কতটা সম্ভব?
সনদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি করে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি উঠেছে কয়েকটি দল থেকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধ্যাদেশ জারি করে সংবিধান পরিবর্তন সম্ভব নয়। অধ্যাদেশ সংসদ অধিবেশন শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে পাস না হলে কার্যকারিতা হারায়।
সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “সংবিধানের যে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে অধ্যাদেশ জারি করে আইনি ভিত্তি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে নয়টি বিষয়ে শতভাগ ঐকমত্য হয়েছে, সেটা অধ্যাদেশ দিয়ে আইনি ভিত্তি দিতে পারে।”
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা একটা সুপারিশ সরকারের কাছে পাঠাব, সেখান থেকে সরকার যেটা ভালো মনে করে করবে। নয়টি বিষয় না দশটি বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করবে, সেটা সরকারের বিষয়।”
সব দল সই করবে কি না: অনিশ্চয়তা
কমিশন ৩০টি দলের কাছে মতামত চেয়েছিল, ২৬টি দল জমা দিয়েছে। চারটি দল মতামত দেয়নি। বামগণতান্ত্রিক জোটের চার দল, গণফোরাম ও বাংলাদেশ জাসদ কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি তুলেছে।
সিপিবির প্রিন্স বলেন, “সনদ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের লিখিত মত তারা জানতে চান। চূড়ান্ত খসড়া দেখার পর আপনাদের জানিয়ে দেব।”
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিলে এটা আমরা কোনোভাবেই মেনে নেব না।”
গণফোরামের মিজানুর রহমান বলেন, “চার মূলনীতি পরিবর্তন করলে স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়।”
বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ প্রায় ২০টি দল সনদে সই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
‘শতভাগ ঐকমত্য’ নিয়ে দ্বন্দ্ব
কয়েকটি দল মনে করে, শুধুমাত্র সব দলের একমত বিষয়গুলোই ঐকমত্য হিসেবে গণ্য হবে। কমিশন বলছে, অধিকাংশ দলের একমতকেই ঐকমত্য বলা হবে।
প্রিন্স বলেন, “যেসব বিষয়ে অনেকে একমত হয়নি, সেসব বিষয়ও ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে খসড়ায় বলা হয়েছে। এরকম থাকলে আমরা ঐকমত্যের পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না।”
যেসব প্রস্তাবে ভিন্নমত
রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন: বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরাম।
রাষ্ট্রপতির নির্বাচনপদ্ধতি: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা: বিএনপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, লেবার পার্টি, এনডিএম, এলডিপি, ১২ দলীয় জোট।
প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদ: বিএনপি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার: বিএনপি, লেবার পার্টি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট।
উচ্চকক্ষে নির্বাচন: বিএনপি, এনডিএম।
উচ্চকক্ষের প্রার্থী তালিকা: বিএনপি, এনডিএম।
উচ্চকক্ষের দায়িত্ব: সিপিবি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, এনডিএম, আম জনতার দল।
নারী আসন: সিপিবি, বাসদ, আম জনতার দল।
নিয়োগসমূহ: বিএনপি, এনডিএম, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২ দলীয় জোট।
আইনি ভিত্তি এবং বিশ্লেষকদের মত
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, “যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে, তাহলে এটি কেবল কথার কথা থেকে যাবে।”
এনসিপির আখতার হোসেন বলেন, “জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তির জায়গায় নিয়ে আসতে না পারলে এটি অকার্যকর হয়ে যাবে।”
বিএনপি বলছে, সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া ‘অসম্ভব ও অগ্রহণযোগ্য’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে পরবর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। সংসদে দুই তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে গেলে জাতীয় সংসদ ছাড়া কোনো উপায় নাই। গণভোট করারও সুযোগ নেই।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করতে হলে সংবিধান মেনে শপথ নিলেন কেন? আগামী সংসদ অপেক্ষা করতে হবে।”
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। সনদের চূড়ান্ত খসড়া পাঠানোর পর দলগুলোর সই নেওয়া শেষ হলেই কমিশনের মূল কাজ সমাপ্ত হবে।