#### নারীদের প্রতি ডিজিটাল আগ্রাসন
নারীরা, বিশেষ করে রাজনৈতিক নেত্রীরা, এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এআই-এর মাধ্যমে তৈরি শ্লীলতাহানিমূলক এবং বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। একটি সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ৭০% নারী অনলাইনে এ ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে ৮০% ক্ষেত্রে এআই-এর মাধ্যমে তৈরি অশ্লীল ছবি ও ভিডিও জড়িত। এই কনটেন্ট ব্যক্তিগত নিরাপত্তার পাশাপাশি সমাজে বিভক্তি ও অস্থিরতা বাড়াচ্ছে।
#### জাতীয় সংকটে অপতথ্যের প্রভাব
গত ১৫ জুলাই ঢাকার মিরপুরে সেন্ট্রাল স্কুলে একটি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার ঘটনায় দেশ শোকাচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু এই সময়ে এআই-এর মাধ্যমে তৈরি ভুয়া ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তথ্য যাচাই সংস্থা ফ্যাক্টশিল্ড এই ভিডিওগুলোকে এআই-চালিত কল্পিত দৃশ্য হিসেবে শনাক্ত করেছে, যেখানে ভুল তথ্য, ভবনের অমিল এবং ভাষাগত ত্রুটি ছিল। এই ঘটনা জাতীয় দুর্যোগের সময়ে এআই অপব্যবহারের ভয়াবহ প্রভাবের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
#### প্রশাসনিক ও আইনি অপ্রতুলতা
সরকার এআই অপব্যবহার রোধে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রিয়াজুল হক বলেন, “সাইবার নিরাপত্তা আইনে এআই অপব্যবহার রোধের বিধান থাকলেও, আইন প্রয়োগে ঘাটতি এবং জনগণের সীমিত ডিজিটাল সচেতনতা এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাসান মাহমুদ বলেন, “বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এআই অপব্যবহার রোধে প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশেও নজরদারি টিম গঠন, নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ভূমিকা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।”
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ নাদিয়া রহমান বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই-চালিত অপতথ্যের বিস্তার অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা রোধে কঠোর আইন, তথ্য যাচাই প্ল্যাটফর্ম এবং মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধি ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।”
#### সোশ্যাল মিডিয়ায় অপতথ্যের ব্যাপকতা
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে ৯০% পোস্ট এআই রিকমেন্ডেশনের মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। গত ছয় মাসে ভুল তথ্য ছড়ানোর হার প্রায় ৩০০ গুণ বেড়েছে, যা রাজনৈতিক অপপ্রচার এবং সামাজিক বিভাজনকে আরও তীব্র করছে। ডিপফেক, সিন্থেটিক ভিডিও এবং ভয়েস ক্লোনিং প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সাধারণ মানুষকে বাস্তবসদৃশ ভুয়া কনটেন্ট তৈরির সুযোগ দিচ্ছে। প্রযুক্তিবিদরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের আগে এই কনটেন্ট ডিজিটাল সহিংসতা ও অপপ্রচারকে বহুগুণ বাড়িয়ে তুলবে।
#### আইনি ও নীতিগত শূন্যতা
বাংলাদেশে এআই অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোনো নির্দিষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন, এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা, ডিপফেক শনাক্তকরণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারির জন্য বিশেষ টিম গঠন করা জরুরি।
অধ্যাপক হাসান মাহমুদ বলেন, “অপতথ্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশনের উচিত বিশেষ টিম গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট পর্যবেক্ষণ করা।”
নাদিয়া রহমান যোগ করেন, “এআই-চালিত কনটেন্টের বিস্তার রোধে ফেসবুক, এক্স এবং ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সরকারের সরাসরি সমন্বয় এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।”
#### ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ও সমাধান
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এআই প্রযুক্তির ইতিবাচক সম্ভাবনার পাশাপাশি এর অপব্যবহার রোধে বহুমুখী পদক্ষেপ অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে:
- কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
- উন্নত তথ্য যাচাই ও ডিপফেক শনাক্তকরণ প্রযুক্তির প্রয়োগ
- প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে নজরদারি টিম গঠন
- জনগণের ডিজিটাল ও মিডিয়া সাক্ষরতা বৃদ্ধির উদ্যোগ
- সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক সতর্ক করে বলেন, “নির্বাচনের আগে এআই-চালিত অপতথ্যের বৃদ্ধি দেশকে গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এখনই সমন্বিত ও দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
#### উপসংহার
বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার একটি গভীর সংকটে রূপ নিচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক ডিজিটাল সচেতনতা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা অসম্ভব। অন্যথায়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং দেশের ভবিষ্যৎ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে, এবং ডিজিটাল জগতে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেড়ে যাবে।