রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় সমাবেশ’ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। শনিবার (১৯ জুলাই ২০২৫) বিকালে লাখো নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই ঘটনা শুধু দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়, বিশ্ব গণমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।
বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আগামী বছর প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনের আগে শক্তি প্রদর্শনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী রাজধানী ঢাকায় এই বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, আগামী এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, তবে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে বিএনপি ও তাদের মিত্রদেরও জোরালো দাবি রয়েছে।
এপি’র প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া জামায়াতে ইসলামী দাবি করেছিল, তারা এই সমাবেশে ১০ লাখ মানুষের সমাগম ঘটাবে। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর, তৎকালীন শাসনামলে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও অন্যান্য গুরুতর অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
জামায়াতে ইসলামী এই সমাবেশের মাধ্যমে সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে— অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিতকরণ, সকল গণহত্যার বিচার, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার, গত বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন, এবং এক কোটির বেশি প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম জামায়াতে ইসলামীকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জামায়াত আশা করছে, তারা আসন্ন নির্বাচনে ৩০০টি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এবং বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পর দেশের তৃতীয় শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ লক্ষ্যে তারা অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
এপি আরও জানিয়েছে, সমাবেশের আগে জামায়াতের হাজার হাজার সমর্থক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাত্রিযাপন করেছেন। শনিবার সকালে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হন। এই উদ্যান ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে, কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এখানেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, যা দিয়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে।
সমাবেশে উপস্থিত এক সমর্থক ইকবাল হোসেন (৪০) অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, “আমরা এখানে এমন একটি নতুন বাংলাদেশের জন্য এসেছি, যেখানে ইসলাম হবে শাসনব্যবস্থার মূলনীতি, যেখানে ভালো ও সৎ লোকেরা দেশ শাসন করবে এবং কোনো দুর্নীতি থাকবে না। প্রয়োজনে আমরা এই লক্ষ্যে আমাদের জীবন উৎসর্গ করব।”
অপর এক সমর্থক, ২০ বছর বয়সী ছাত্র মহিদুল মোরসালিন সায়েম বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর অধীনে এই দেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সব মানুষের তাদের অধিকার থাকবে। কারণ আমরা পবিত্র কোরআনের পথ অনুসরণ করি।” তিনি আরও বলেন, “যদি সমস্ত ইসলামী দল শিগগিরই হাত মেলায়, তাহলে কেউ আমাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারবে না।”
এই সমাবেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তাদের সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রদর্শন করেছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।