বুধবার, ৬ আগস্ট, ২০২৫

এনসিপি নেতাদের কক্সবাজার সফর: গোপন বৈঠকের গুজব, গোয়েন্দা নজরদারিতে বাড়ছে জল্পনা

 
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পাঁচ শীর্ষ নেতার হঠাৎ কক্সবাজার সফর নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই তাদের এই সফর, বিলাসবহুল রিসোর্টে অবস্থান, এবং আকস্মিক হোটেল পরিবর্তন—সব মিলিয়ে উঠেছে রহস্য ও কৌতূহল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি এবং বিদেশি কূটনীতিকের সঙ্গে গোপন বৈঠকের গুজব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।

মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) বেলা সাড়ে ১১টায় বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৪৩৩ ফ্লাইটে কক্সবাজার পৌঁছান এনসিপির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা এবং যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ। বিমানবন্দর থেকে তারা সরাসরি ইনানীর বিলাসবহুল সী পার্ল রিসোর্টে (পূর্বের রয়েল টিউলিপ) যান।

বুধবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে তারা হঠাৎ রিসোর্ট ত্যাগ করে কলাতলীর শালিক রেস্টুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করেন। এরপর বিকাল ৩টার দিকে শহরের অভিজাত হোটেল ‘প্রাসাদ প্যারাডাইসে’ ওঠেন। এই আকস্মিক স্থান পরিবর্তন স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক মহলের নজর এড়ায়নি।

গোয়েন্দা নজরদারি ও গোপন বৈঠকের গুজব

এনসিপি নেতাদের এই সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা চলছিল। বিশেষ করে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে সম্ভাব্য গোপন বৈঠকের গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে। এই গুজবের পরপরই ডিজিএফআই ও এনএসআইসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তৎপর হয়ে ওঠে। রয়েল টিউলিপ হোটেলের ভেতরে ও বাইরে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সদস্যরা অবস্থান নেন এবং হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে কোনো বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতি বা বৈঠকের চেষ্টা ছিল কিনা তা যাচাই করা হয়।

রয়েল টিউলিপের সিকিউরিটি প্রধান, সাবেক নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কামরুজ্জামান বলেন, “আমাদের হোটেলে এনসিপি নেতাদের সঙ্গে কোনো বিদেশির বৈঠক হয়নি। এমনকি হোটেলে কোনো বিদেশি নাগরিকও ছিলেন না।” তিনি আরও জানান, মঙ্গলবার দুপুর থেকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা হোটেলে এসে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করেছেন।

গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন সদস্য জানান, ঊর্ধ্বতন নির্দেশে তারা এনসিপি নেতাদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো গোপন বৈঠকের নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

এনসিপি নেতাদের এই সফর শুধু গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরই নজর কাড়েনি, বরং তাদের নিজ দলের মধ্যেও অস্বস্তি তৈরি করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দিনে কোনো তথ্য না জানিয়ে কক্সবাজার সফরে যাওয়ায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে পাঁচ নেতার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়।

দলের যুগ্ম সদস্য সচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, “গত ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বর্ষপূর্তি ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে আপনারা ব্যক্তিগত সফরে কক্সবাজারে গেছেন, অথচ এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্ষদকে কোনো তথ্য বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সশরীরে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।”

স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

এনসিপি নেতাদের এই সফর কক্সবাজারের স্থানীয় রাজনৈতিক মহলেও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেন, “মঙ্গলবার আমি টেকনাফে ছিলাম। এর মধ্যে এনসিপির কয়েকজন নেতা কক্সবাজারের একটি হোটেলে এসেছেন বলে শুনেছি। নানা ধরনের কথাও শুনেছি, কিন্তু এসবের সত্য-মিথ্যা জানি না। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।”

কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দিন জানান, এনসিপি নেতারা কোনো প্রটোকল চাননি, তবু তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রাসাদ প্যারাডাইস হোটেলের আশপাশে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে ধোঁয়াশা

দুই দিন পার হলেও এনসিপি নেতাদের এই সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানাচ্ছে, কোনো গোপন বৈঠকের প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি, তবে নজরদারি অব্যাহত আছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছে, বিদেশি যোগাযোগের গুজব পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী গুজব অস্বীকার করে বলেন, “কারও সঙ্গে দেখা করতে নয়, হুট করেই আমরা ঘুরতে এসেছি। পদযাত্রা কর্মসূচির ধকল সামলাতেই সাগরপাড়ে একটু বিশ্রাম নিতে এসেছি।” তিনি এই গুজবকে ‘মিডিয়া প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

কক্সবাজারের পর্যটন নগরীতে এনসিপি নেতাদের হঠাৎ সফর এবং তা ঘিরে গোয়েন্দা তৎপরতা এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। সবার দৃষ্টি এখন প্রাসাদ প্যারাডাইস হোটেলের দিকে—এই নেতাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে কৌতূহল তুঙ্গে।


Share This Post

শেয়ার করুন

Author:

Note For Readers: The CEO handles all legal and staff issues. Claiming human help before the first hearing isn't part of our rules. Our system uses humans and AI, including freelance journalists, editors, and reporters. The CEO can confirm if your issue involves a person or AI.