বৈঠকগুলোতে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কেউ যদি নির্বাচনের বিকল্প নিয়ে ভাবে, সেটা জাতির জন্য গভীর বিপজ্জনক।” এই বার্তা তিনি রোববারের বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির নেতাদের কাছে তুলে ধরেন।
বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, “প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে নির্বাচনের যে সময় ঘোষণা করেছেন, সেই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এটি হবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা নির্বাচন—অবাধ, সুষ্ঠু এবং উৎসবমুখর পরিবেশে।”
বিএনপির সঙ্গে বৈঠক
রোববার সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল জানান, প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “একটি শক্তি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে, তবে নির্বাচন পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার বিষয়ে বিএনপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এটির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর শঙ্কা
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান এবং হামিদুর রহমান আযাদ। বিকাল সোয়া ৪টায় শুরু হওয়া এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে সৈয়দ আবদুল্লাহ বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা অবাধ নির্বাচনের কথা বলেছেন, আমরা তার সঙ্গে একমত। কিন্তু কার্যকারিতার বিষয়ে আমাদের সংশয় রয়েছে।” তিনি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের সমালোচনা করে বলেন, “নির্বাচনের সময় ঘোষণা চাপে পড়ে করা হয়েছে। জুলাই সনদের বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়ার পর নির্বাচন ঘোষণা করা উচিত ছিল।” জামায়াত জুলাই চার্টারের পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের মাধ্যমে এর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। তারা জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিও তুলেছে, অভিযোগ করে যে এই দল আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।
এনসিপির দাবি: গণপরিষদ নির্বাচন
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রতিনিধিদল বিকাল সাড়ে ৫টায় যমুনায় প্রবেশ করে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। বৈঠক শেষে আরিফুল ইসলাম বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী নির্বাচন গণপরিষদ নির্বাচন হওয়া উচিত। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামোর স্থায়ী সমাধান দেবে।” তারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পুনর্বাসন, নিরাপত্তা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আটক ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছে। এনসিপিও জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
জাতীয় পার্টি নিয়ে আলোচনা
বৈঠকগুলোতে জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বিভিন্ন দল বিভিন্ন মতামত দিয়েছে, এবং প্রধান উপদেষ্টা সেগুলো শুনেছেন। তবে বিএনপি জানিয়েছে, তাদের বৈঠকে জাতীয় পার্টি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। জামায়াত এবং এনসিপি জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে, অভিযোগ করে যে এই দল আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে।
উপস্থিত উপদেষ্টারা
বৈঠকগুলোতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তবে সব বৈঠকে সব উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন না।
নির্বাচনের সময় নিয়ে বিতর্ক
প্রধান উপদেষ্টার লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক এবং নির্বাচনের সময় ঘোষণা নিয়ে কিছু দলের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। জামায়াতের নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ অভিযোগ করেন, এই ঘোষণা সব দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই করা হয়েছে, যা নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলেছে। তবে বিএনপির মির্জা ফখরুল এই অভিযোগকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার যে কোনো দলের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করার এখতিয়ার রয়েছে।”
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সমন্বয় করছে। প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়েছেন, নির্বাচন যেন ভোটার উপস্থিতি, শান্তি-শৃঙ্খলা এবং সৌহার্দ্যের দিক থেকে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়।